স্মৃতিচারণা
-সুনির্মল বসু
(ক্যানভাসে কত ছবি, স্মৃতিতে হেঁটে যায় কত উন্মনা মুখ)
পলে পলে দিন, দিনে দিনে মাস, মাসে মাসে বছর, এভাবেই কত বর্ষা বসন্ত পেরিয়ে আজ জীবনের অস্তাচল পর্বে আমি। পিছনের দিকে তাকালে, বড় মায়াময় অনুভব ঘিরে ধরে আমাকে। ঠাকুরমার হাত ধরে প্রথম দিন স্কুলে যাওয়া, হলুদ বাড়িটাকে কী ভয় লেগেছিল সেদিন। সমীর, গিরিন, বন্ধু হয়েছিল। টিফিনে আমসত্ত্ব ভাগ করে খেতাম আমরা, বন্ধু কমল বলতো, দিয়ে খাবি, নইলে পেট ফুলবে। কদবেল গাছে ঢিল মেরে, ফুটবল খেলে, বর্ষার দিনে সোনা ব্যাঙ ধরে, দিন কাটছিল বেশ। সবুজ মাঠ পেরিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম, চারদিকে অনেক কোয়ার্টার, মাসিমারা বলতেন- ভালো কইরা পড়াশুনা করিস। সেসব কোয়ার্টার এখন আর নেই, আকাশ ছোঁয়া আলিশান ফ্লাট তৈরি হয়েছে। ভালোবাসার মানুষগুলোকে আর দেখতে পাই না, বিকেলে নদীর ধারে এসে দাঁড়ালে, নদীর জলে দেখি, স্মৃতির ঢেউ। ওপারে তাকালে মনে হয়, প্রিয় মানুষ জীবনের অপর পাড়ে চলে গিয়েছেন। বিকেলে আমাদের খেলার জন্য গাছ কেটে ব্যাট বানিয়ে দিয়েছিলেন শ্যামলাল কাকু। ফুটবল খেলার আয়োজন করতেন, সুরেন কাকু। আমরা আপন পর বুঝতাম না, পড়ায় ফাঁকি দিলে, পাড়ার মাসিমারা বকতেন, মায়ের শরীর খারাপ হলে রান্না করে দিয়ে যেতেন। পাড়ার একটি মাত্র রেডিওতে শুক্রবার হলে মায়েদের নিমন্ত্রণ হোত, নাটক শোনার। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান-এর খেলা হলে, পথে দাঁড়িয়ে আমরা রেডিওতে রিলে শুনতাম। পুজোর সময় বিশাল প্যান্ডেল হত, জলে পদ্ম শালুক ফুটে থাকতো, আকাশটা কত ঘন নীল ছিল, বাটা ব্রিজের উপর বিশাল একটা গেট হত। স্কুল ছুটির পর আমাদের কাজ ছিল, প্যান্ডেল কতটা হয়েছে দেখা। ঠাকুর এলে, মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। স্কুল ছুটি, পড়াশুনা বন্ধ। চারদিকে সার্কাস ম্যাজিক পুতুল খেলা। প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা, ভোগ খাওয়া, রাত জেগে যাত্রা দেখা, কীসব মায়াময় দিন। পুজোর সময় পাড়ার মেয়েদের ও দেবী দেবী মনে হতো, কথা বলে দূরে থাক, চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা হত।
বড় হচ্ছিলাম। কলেজ, সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, সংসারে বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো, মনে হয় যেন ছায়াছবির মতো দৃশ্যপট।
আমার চোখের সামনে, আমাদের প্রিয় উপশহরটা কেমন বদলে গেল। পুজোর আগে আগমনী গান শোনাতেন যারা, এখন আর তাদের দেখা পাই না। এই সময় এর পক্ষে তারা জরুরী নন। আধুনিকতার ঝড়ে আমাদের ভালোবাসার ভুবন ভেঙে পড়েছে। আমাদের ভালোবাসার সরল মানুষগুলো অনেকেই পরপারে চলে গিয়েছেন, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকলেও, তারা আর কখনো ফিরবেন না। চোখের সামনে এখন যাদের দেখি, তাদের অতি আধুনিক জীবন প্রণালী অদ্ভুত লাগে। জীবন থেকে আন্তরিকতা ভ্যানিশ, ভালোবাসা আভিধানিক শব্দ। মা অসুস্থ হলে, পাশের বাড়ির মাসিমা রান্না করে খেতে ডাকতেন, খাইয়া যা, না খাইয়া স্কুলে যাবি না। তখন নিরুচ্চার স্নেহ ছিল, ভালোবাসা ছিল। হৃদয়ের শূন্য তাকে ঢাকবার জন্য কত আয়োজন এখন।
একটা বয়সে এলে, হারানোর বেদনা হৃদয়কে ছুঁয়ে ফেলে, বাবা মা নেই, কাকু নেই, পাড়ার কাকু কাকিমারা নেই। আগমনী গান নেই, বাউলের মন মাতানো সুর নেই, অনুরোধের আসর নেই। রাত জেগে হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, আরতী, হৈমন্তী শুক্লার গান নেই। প্রাসাদের নিচে বস্তি, সাধারণ মানুষের প্রতি দিনকার বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
নদীর কাছে দাঁড়ালে, নদীর জলে দেখি, ভাসমান পুরনো দিনের স্মৃতি, সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে, মনে হয়, দূরে অপর পাড়ে, প্রিয় মানুষরা হেটে যাচ্ছেন। ইচ্ছে হয়, ডেকে বলি, আমাদের কোথায় রেখে গেলেন বলুন তো।
হু হু বাতাস ছাড়া এ দীর্ঘশ্বাসের কোন জবাব মেলে না। প্রিয় মানুষ, কত প্রিয় মুখ, কত অযাচিত ভালোবাসা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। নদীর মধ্যে কাছের নৌকাগুলো যেমন দূরে সরে যায়, সেভাবেই সময় সরে গেছে, জীবনে পালাবদলের পালা ঘটে গেছে, ফেরানো যাবে না তাকে আর। তবু, মহালয়ার সুর, ঢাকের বাদ্যি, মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেওয়া, মায়ের হাতে বানানো নারকেল নাড়ু, মোয়া খাবার স্মৃতিগুলো, আজও কেমন যেন অলৌকিক মনে হয়।
সময় বদলেছে। আগমনী গান শোনাতেন যারা, তাদের মত এই স্মৃতিগুলো একদিন জীবনের ক্যানভ্যাস থেকে মুছে যাবে।
একালের তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ এসব শুনে বলবেন, আপনারা সব থারটি নাইন মডেল, আপনাদের আমলের এইসব মান্ধাতার ভাবনা এখন আর চলে না।
তবু আমার মত অস্তগামী সূর্যেরা ঠিক একবার পিছন ফিরে তাকাবেন অবশ্য, মনে মনে বলবেন, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।